LexSword

Your Justice, Our Mission

+88 01911 008 518

শিশুর অভিভাবকত্ব ও ভিজিটিং রাইটস: আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত

 



ভূমিকা

পারিবারিক সম্পর্ক ও অধিকার নিয়ে আইনি বিরোধ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়, যা পরিবার, সমাজ এবং আইনব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে এ ধরনের বিরোধের ক্ষেত্রে, সন্তানের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইরফান সাঈদ বনাম মিসেস রুকশানা মতিন মামলাটি এমন একটি নজির, যেখানে সন্তানের কল্যাণ, পিতামাতার অধিকার, এবং চুক্তির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।  

এই মামলায় প্রধানত বাবা-মায়ের মধ্যে সন্তানকে দেখা এবং তার সঙ্গে সময় কাটানোর অধিকার নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। মামলাটি পারিবারিক আইন এবং চুক্তি আইনের জটিল বিষয়গুলো স্পষ্ট করার পাশাপাশি বিচারিক এখতিয়ার সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। ফলে, এই মামলাটি শুধু সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জন্য নয়, দেশের আইনি পরিমণ্ডলে একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।  

উক্ত মামলার আলোকে সন্তানের প্রতি পিতামাতার অধিকার, চুক্তির বৈধতা, এবং আদালতের এখতিয়ার সম্পর্কে একটি বিশদ আলোচনা অপরিহার্য। এটি সাধারণ জনগণ এবং আইনি পেশাজীবীদের জন্য মূল্যবান দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।  


মামলার পটভূমি

ইরফান সাঈদ বনাম মিসেস রুকশানা মতিন মামলাটি বাংলাদেশে পারিবারিক আইন ও অধিকার সম্পর্কিত একটি উল্লেখযোগ্য মামলা। মামলাটির পটভূমিতে রয়েছে বাবা-মায়ের মধ্যে সন্তানের সাক্ষাৎ এবং অভিভাবকত্ব নিয়ে উদ্ভূত বিরোধ।  

১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি ইরফান সাঈদ ও রুকশানা মতিনের মধ্যে বিবাহবন্ধন হয়। দাম্পত্য জীবনে তাদের একটি পুত্র সন্তান, মোহাম্মদ ইব্রাজ সাঈদ, ১৯৯১ সালের ২৪ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করে। ইরফান সাঈদ উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।  

ইরফানের অনুপস্থিতিতে রুকশানা তাদের সন্তানকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যান এবং সেখানেই থাকতে শুরু করেন। ইরফান ফিরে আসার পর সন্তানের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলে, রুকশানা তা বাধা দেন। এতে করে তাদের মধ্যে বিরোধ চরমে পৌঁছায়।  

পরে উভয়ের সম্মতিতে ১৯৯৪ সালের ২১ আগস্ট একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে নির্ধারিত হয় যে, ইরফান সপ্তাহে তিন দিন—সোমবার, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার, সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর অধিকার পাবেন। চুক্তি অনুযায়ী, সন্তানের মা নিজ দায়িত্বে তাকে ইরফানের বাড়িতে পাঠাবেন।  

কিন্তু কিছুদিন পর রুকশানা এই চুক্তি ভঙ্গ করেন এবং সন্তানের বাবার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। এই পরিস্থিতিতে, ইরফান একটি ম্যান্ডেটরি ইনজাঙ্কশন (বাধ্যতামূলক নির্দেশ) চেয়ে ঢাকার দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলার মূল দাবি ছিল, চুক্তি অনুযায়ী সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাস্তবায়ন।  

মামলা দায়ের করার পর, বাদী ইরফান অস্থায়ী ম্যান্ডেটরি ইনজাঙ্কশন এর জন্য আদালতে আবেদন করেন। 

পরবর্তীতে, রুকশানা আদালতে বাদীর আরজি খারিজের আবেদন দাখিল করে দাবি করেন যে, মামলাটি দেওয়ানি আদালতে নয়, বরং পারিবারিক আদালতে হওয়া উচিত এবং চুক্তিটি আইনগতভাবে অবৈধ। এই বিরোধ নিয়ে মামলাটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।  

বিচারিক বিষয়ে মূল প্রশ্ন

মামলাটি কয়েকটি মূল প্রশ্ন উত্থাপন করে:

পারিবারিক অধিকার: শিশুটির মায়ের অধিকার এবং পিতার সাক্ষাৎ অধিকারের মধ্যে সুষ্ঠু ভারসাম্য কীভাবে বজায় রাখা যায়?

চুক্তির বৈধতা: ১৯৯৪ সালের ২১ আগস্টে করা চুক্তিটি আইনগতভাবে বৈধ কিনা।

আদালতের এখতিয়ার: মামলাটি সাধারণ দেওয়ানি আদালতে নাকি পারিবারিক আদালতে হওয়া উচিত।

বিচারিক আদালতের রায় ও আদেশ

ইরফান সাঈদ তার সন্তানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য ঢাকার ৫ম সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানী মামলা নং ৩৫৪/১৯৯৪ দায়ের করেন। মামলার মূল দাবি ছিল ম্যান্ডেটরি ইনজাঙ্কশনের মাধ্যমে চুক্তি অনুযায়ী সন্তানের সাক্ষাৎ নিশ্চিত করা।

রুকশানা মতিন পক্ষ থেকে মামলার গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জ করে অর্ডার ৭, রুল ১১, সিপিসি অনুসারে প্লেইন্ট খারিজের আবেদন করা হয়। তিনি দাবি করেন, মামলাটি দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত এবং এটি পারিবারিক আদালতে দায়ের হওয়া উচিত।

বিচারিক আদালত এই আবেদন খারিজ করে এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সন্তানের সাক্ষাৎ নিশ্চিত করার জন্য অস্থায়ী ম্যান্ডেটরি ইনজাঙ্কশন জারি করে। আদেশে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার ও সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১:৩০টা পর্যন্ত সন্তানের সাক্ষাৎ দিতে হবে।


হাইকোর্টের রায়:

হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় একক বিচারপতি ১৯৯৪ সালের ৫ এপ্রিল মামলার শুনানি শেষে রিভিশন আবেদন গ্রহণ করেন এবং নিম্ন আদালতের আদেশের স্থগিতাদেশ দেন। এরপর, বাদী স্থগিতাদেশটি বাতিল করার জন্য আবার আবেদন করেন। হাইকোর্ট উভয় পক্ষের শুনানি গ্রহণের পর, আদেশ সংশোধন করে বলেন যে প্রতিপক্ষ শিশুকে প্রতি সপ্তাহে একদিন (শুক্রবার) বাদীর বাসায় পাঠাবেন, পূর্ববর্তী আদেশে নির্ধারিত দুই দিনের পরিবর্তে। 

অবশেষে, রুলের চূড়ান্ত শুনানিতে হাইকোর্ট বাদীর পক্ষে চলমান মামলার প্লেইন্ট খারিজ করে দেন এবং রুলকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করেন, তবে বাদীকে ১,০০০ টাকা খরচ প্রদান করার আদেশ দেন।  

হাইকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ:

হাইকোর্টের এই রায়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:

 ১। মায়ের অধিকার ও শিশুর মানসিক উন্নয়ন:
  আদালত জানিয়েছেন যে, আইনগতভাবে মা-ই শিশুর একমাত্র অভিভাবক। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত আইনানুগ নীতি, যেখানে মায়ের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এই নীতির উপর ভিত্তি করে আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে শিশুটিকে বাবার তত্ত্বাবধানে পাঠানো আইনগতভাবে সঠিক নয় এবং তা শিশুর মানসিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। 

২।  চুক্তির বৈধতা:
   আদালত চুক্তি আইন, ১৮৭২ এর ধারা ২৩-এ উল্লিখিত অবস্থার পরিপন্থী হিসেবে এই চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে চুক্তির উদ্দেশ্য এবং প্রেক্ষাপট আইনসম্মত না হওয়া, শিশুদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া এবং জনস্বার্থের পরিপন্থী হওয়ার কারণে চুক্তিটি বৈধ নয় বলে মন্তব্য করেন।  

৩। পাবলিক পলিসি এবং সংবিধানিক অধিকার:
   আদালত এটাও বলেন যে, চুক্তির যে শর্তে শিশুকে বাবার বাসায় পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তা জনস্বার্থের পরিপন্থী। এছাড়া, চুক্তি প্রয়োগে যদি কোনো পক্ষের সংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তবে তা আইনি প্রতিকার পাওয়ার উপযোগী নয়।

৪। বাধ্যতামূলক আদেশ এবং আইনের নিয়ম:
   ম্যান্ডেটরি ইনজাঙ্কশন বা বাধ্যতামূলক আদেশের মাধ্যমে এই ধরনের চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন করা যায় না। আদালত জানিয়েছেন, চুক্তির শর্তাবলী বাস্তবায়ন আইনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে পড়ে না এবং তাই কোনও আদালত এমন আদেশ দেন না। 

আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত:


এই মামলার আপিল বিভাগের রায় হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। আপিল বিভাগের রায় মূলত হাইকোর্টের সিদ্ধান্তকে বাতিল করেছে এবং বাদীর (ইরফান সাঈদ) পক্ষে রায় প্রদান করেছে। 

এটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

১. হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়:
   আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং এটি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আদালত উল্লেখ করেন যে, হাইকোর্ট যে আইনি নীতি অনুযায়ী রায় প্রদান করেছে, তা যথার্থ নয়। হাইকোর্ট শিশুর অভিভাবকত্ব এবং তার মানসিক উন্নয়নের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। আপিল বিভাগ বলেন যে, মামলার মূল প্রশ্ন ছিল বাদীর ভিজিটিং রাইটস, অর্থাৎ বাদী তার পুত্রের সাথে দেখা করার অধিকার পাবে কি না, এবং অভিভাবকত্ব বিষয়টি আলোচনার মূল বিষয় ছিল না। 

২. শিশুর শারীরিক এবং মানসিক উন্নয়ন:
   আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের এই যুক্তির সাথে একমত হননি যে শিশুর মানসিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি তাকে বাবার কাছে পাঠানো হয়। আপিল বিভাগ বলেন, শিশুর মঙ্গল এবং বাবার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য দেখা করার অধিকার একান্তভাবে শিশুর উপকারে আসবে। এমনকি শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের পক্ষে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাকে বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে সাহায্য করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে, আপিল বিভাগ বিশ্বাস করেন যে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যে কোনো ক্ষতি হবে না যদি সে সপ্তাহে একদিন তার বাবা বা মায়ের সাথে সময় কাটায়। 

৩. বাবার অধিকার:

   আপিল বিভাগ আরও বলেন, চুক্তির বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ছিল। বাদী, যিনি পুত্রের বাবা, তারও একটি বৈধ অধিকার ছিল তার সন্তানের সাথে দেখা করার। একটি পিতার ভিজিটিং রাইট (শিশুর সাথে দেখা করার অধিকার) কোনোভাবে অভিভাবকত্বের সাথে সংযুক্ত নয়, বরং এটি ব্যক্তিগত অধিকার যা একটি সন্তানের ভালো সুরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। যদি একটি বাবা তার সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং শিশুর মঙ্গল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তবে তাকে দেখা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না।

৪. আইনের মৌলিক নীতি:
   আপিল বিভাগ বলেছিল যে হাইকোর্টে প্রয়োগকৃত আইনি নীতির ভিত্তি ভুল ছিল। আইন অনুযায়ী, শিশুর স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত, এবং তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। আপিল বিভাগ মনে করেন যে, বাবা এবং সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে শিশুর উপকারে আসবে, এবং এটি তার মঙ্গলের জন্য ক্ষতিকর হবে না।

৫. চুক্তির বৈধতা এবং জনস্বার্থ:
   আপিল বিভাগে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছিল। হাইকোর্ট চুক্তির বৈধতা নিয়ে যে রায় দিয়েছিলেন, আপিল বিভাগ সেটিকে অগ্রাহ্য করেছে। আপিল বিভাগ স্পষ্টভাবে জানান যে, চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই, কারণ এটি বাবা-মেয়ের সম্পর্ক উন্নয়ন এর জন্য একটি সম্পূর্ণ বৈধ এবং সুরক্ষিত চুক্তি। 

   সুতরাং, জনস্বার্থ বা আইনের পরিপন্থী এমন কিছু ছিল না যা এই চুক্তির বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। চুক্তি অনুসারে, বাদী তার সন্তানকে প্রতি সপ্তাহে একদিন তার কাছে পেতে পারেন, এবং তা বাবার ভিজিটিং রাইট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।

৬. সাংবিধানিক অধিকার:
   আপিল বিভাগ আরও বলেন, হাইকোর্টের রায় সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল ছিল। যদি কোনো পক্ষের মৌলিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেমন ব্যক্তিগত অধিকার, তা সংবিধান অনুযায়ী রক্ষা করা উচিত। শিশুদের অধিকারও সংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত, তবে বাবা-মায়ের সম্পর্ক সন্তানের মঙ্গলে থাকা উচিত এবং তা বিচারাধীন হতে পারে। 


উপসংহার:
আপিল বিভাগের রায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন বাবার অধিকার সুরক্ষিত হলো, অন্যদিকে শিশুর মঙ্গল ও তার মানসিক উন্নয়নের জন্য যথাযথ আইনি দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি সিদ্ধান্ত, যেখানে আদালত শিশুর অধিকারের পাশাপাশি পিতামাতার সম্পর্কের গুরুত্বও স্বীকৃতি দিয়েছে।

উৎস: 48 DLR (AD) (1996) 134
LexSword | All rights reserved.
Developed by Pro Templates
Disclaimer

In compliance with the rules of the Bar Council of Bangladesh, we do not solicit work or advertise. By clicking 'I AGREE', you acknowledge and agree to the following: